আল্লাহভীতি ও সংযমশীলতা এবং কোরআন ও হাদীসের আলোকে তাকওয়া



আল্লাহকে ভয় করে চলা এমন একটি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য, যা অন্তরে যথাযথ প্রোথিত হলে জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। আর এই পরিবর্তনটি আসে আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নির্দেশ মোতাবেক। সুদূর অতীতকালের একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘তুমি যখন অন্যদের ভয় পাও, তাদের থেকে দূরে পালিয়ে যাও। আর যখন আল্লাহকে ভয় পাও, তখন তাঁর দিকেই তুমি ছুটে যাও।’

আপনি আল্লাহ তায়ালা, তাঁর নিখুঁত গুণাবলি এবং সর্বপরিবৃত জ্ঞানভিত্তিক কাজ সম্পর্কে যত বেশি জানবেন, তত বেশি ভয়, ভক্তি ও শ্রদ্ধা করবেন তাঁকে। আপনি যত বেশি জানতে পারবেন আপনার অতি তুচ্ছ, নগণ্য ও পাপী সত্তার ব্যাপারে, ততই আল্লাহর ভীতি আপনার মনে প্রবল হয়ে উঠবে।


এ কারণে আল কুরআন সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে, আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে কেউই প্রকৃতপক্ষে ভয় করে না, তারা ছাড়া যারা (আল্লাহর কথা ও কাজ সম্পর্কে) সম্যক জ্ঞানের অধিকারী (সূরা আল মুমিনুন, আয়াত ২৮)।

মহান আল্লাহ বলেছেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِۦ﴾ [ال عمران: ١٠٢]

অর্থাৎ “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর।” (সূরা আলে ইমরান ১০২ আয়াত)

উক্ত আয়াতে যথার্থভাবে ভয় করার ব্যাখ্যা রয়েছে এই আয়াতে;

তিনি বলেন,

﴿ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ ﴾ [التغابن: ١٦]

অর্থাৎ “তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর।” (সূরা তাগাবুন ১৬ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَقُولُواْ قَوۡلٗا سَدِيدٗا ٧٠ ﴾ [الاحزاب: ٧٠]

অর্থাৎ “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল।” (সূরা আহযাব ৭০ আয়াত)

তিনি অন্যত্র বলেন,

﴿ وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مَخۡرَجٗا ٢ وَيَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَيۡثُ لَا يَحۡتَسِبُۚ ﴾ [الطلاق: ٢، ٣]

অর্থাৎ “আর যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে আল্লাহ তার নিস্কৃতির পথ করে দিবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রুযী দান করবেন।” (সূরা ত্বালাক্ব ২-৩ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن تَتَّقُواْ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّكُمۡ فُرۡقَانٗا وَيُكَفِّرۡ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۗ وَٱللَّهُ ذُو ٱلۡفَضۡلِ ٱلۡعَظِيمِ ٢٩ ﴾ [الانفال: ٢٩]

অর্থাৎ “যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্যকারী শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতিশয় অনুগ্রহশীল।” (সূরা আনফাল ২৯ আয়াত)

আল্লাহভীতি, সংযমশীলতা ও তাক্বওয়া-পরহেযগারীর গুরুত্ব সম্বন্ধে আরো অনেক আয়াত রয়েছে।


এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য হাদীসসমূহ নিম্নরূপঃ-

১/৭০। আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রশ্ন করা হল যে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি কে?’ তিনি বললেন, ‘‘তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে আল্লাহ-ভীরু।’’ অতঃপর তাঁরা (সাহাবীরা) বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি না।’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে ইউসুফ (সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি), যিনি স্বয়ং আল্লাহর নবী, তাঁর পিতা নবী, পিতামহও নবী এবং প্রপিতামহও নবী ও আল্লাহর বন্ধু।’’ তাঁরা বললেন, ‘এটাও আমাদের প্রশ্ন নয়।’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে তোমরা কি আমাকে আরবের বংশাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছ? (তবে শোনো!) তাদের মধ্যে যারা জাহেলী যুগে ভাল, তারা ইসলামেও ভাল; যদি দ্বীনী জ্ঞান রাখে।’’[1]

 

তাকওয়ার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে খোদাভীতি, হরহেযগারী, বিরত থাকা, আত্মশুদ্ধি। আর শরীয়াতের পরিভাষায়- আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর বিধি-বিধান মেনে চলার নাম তাকওয়া।

তাকওয়া বা খোদাভীতি সম্পর্কে আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত যিনি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব বিষয়ে অবহিত।’ (হুজরাত ১০)

‘হে ঈমানদার লোকেরা! আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেন লক্ষ্য করে যে, সে আগামী দিনের জন্য কি সামগ্রীর ব্যবস্থা করে রেখেছে। আল্লাহকেই ভয় করতে থাক। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের সেসব আমল সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা কর।’ (হাশর ১৮)

‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর, তাকে যেরূপ ভয় করা উচিত। তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ (আল ইমরান ১০২)

‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল ইলম সম্পন্ন লোকেরাই তাঁকে ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহাশক্তিশালী ও ক্ষমাকারী।’ (ফাতির ২৮)

‘আল্লাহ তো তাদের সঙ্গে রয়েছেন, যারা তাকওয়া সহকারে কাজ করে এবং ইহসান অনুসারে আমল করে।’ (নাহল ১২৮)

‘আর সফলকাম হবে ওইসব লোক যারা আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম পালন, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর নাফরমানী হতে দূরে থাকে।’ (নূর ৫২)

‘যারা নিজেদের অদৃশ্য আল্লাহকে ভয় করে, নিশ্চয়ই তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও অতিবড় সুফল।’ (মূলক ১২)

‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা যখন পরস্পরে গোপন কথা বল, তখন গুণাহ, বাড়াবাড়ি ও রাসূলের নাফরমানির কথাবার্তা নয়, বরং সৎ কর্মশীলতা ও আল্লাহকে ভয় করে চলার (তাকওয়ার) কথাবার্তা বল এবং সেই আল্লাহকে ভয় করতে থাক যার দরবারে তোমাদেরকে হাশরের দিন উপস্থিত হতে হবে।’ (মুজাদালা ৯)

‘যেসব কাজ পূণ্য ও ভয়মূলক তাতে একে অপরকে সাহায্য কর, আর যা গুণাহ ও সীমা লংঘনের কাজ তাতে কারো একবিন্দু সাহায্য ও সহযোগিতা করো না। আল্লাহকে ভয় কর, কেননা তাঁর দণ্ড অত্যন্ত কঠিন।’ (মায়েদা-২)

তাকওয়া সম্পর্কে হাদীস : আতিয়া আস-সাদী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোন ব্যক্তি পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা যেসব কাজে গুণাহ নেই তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত খোদাভীরু লোকদের শ্রেণীভুক্ত হতে পারে না। (তিরমিযি ও ইবনে মাজা)

আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে আয়েশা। ছোটখাট গুণাহর ব্যাপারেও সতর্ক হও। কেননা এ জন্যও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। (ইবনে মাজা)

ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর নির্ধারিত রিযিক পূর্ণমাত্রায় লাভ না করা পর্যন্ত কোন লোকই মারা যাবে না। সাবধান! আল্লাহকে ভয় কর এবং বৈধ পন্থায় আয় উপার্জনের চেষ্টা কর। রিযিকপ্রাপ্তিতে বিলম্ব যেন তোমাদেরকে অবৈধ পন্থা অবলম্বনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা কিছু রয়েছে তা কেবল আনুগত্যের মাধ্যমে লাভ করা যায়। (ইবনে মাজা)

হাসান ইবনে আলী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জবান মুবারক হতে এই কথা মুখস্থ করে নিয়েছি, যে জিনিস সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেয় তা পরিত্যাগ করে যা সন্দেহের ঊর্ধ্বে তা গ্রহণ কর। কেননা সততাই শান্তির বাহন এবং মিথ্যাচার সন্দেহ সংশয়ের উৎস। (তিরমিযি)

রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহকে তাঁর জীবনে সর্বাস্থায় ভয় করতেন, তা ছিল মহব্বতের ভয়। কেননা দুনিয়াতেই বলা হয়েছে যে, জাহান্নাম তাঁর জন্য হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বান্দাদের মাঝে আলেমরাই আল্লাহকে ভয় করে’। এখানেও দ্বিতীয় প্রকারের ভয় তথা মহব্বতের ভয়ের কথাই বলা হয়েছে। আল্লাহ আমাদের সবার অন্তরে তাঁহার প্রকৃত ভয় অনুভূত করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)

(কুরআন ও হাদীস সঞ্চয়ন গ্রন্থ)

No comments:

Post a Comment