হাদিস সংকলনের ইতিহাস | Hadith | হাদিস


হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে সাহাবি ও তাবেয়ীগণ প্রয়োজন অনুসারে কিছু হাদীস লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয হাদীস সংগ্রহের জন্য মদীনার শাসনকর্তা আবু বকর বিন হাজম সহ মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা ও আলিমগণের কাছে একটি ফরমান জারী করেন যে, আপনারা মহানবী হাদীসসমূহ সংগ্রহ করুন।

 


 ইসলামে হাদিস ( /ˈhædɪθ/[১] বা /hɑːˈdiːθ/ [২] আরবি: حديث‎‎ , ḥadīṯ, আরবি উচ্চারণ: [ħadiːθ], pl. aḥādīth, أحاديث , ʾaḥādīṯ,[৩][ক] আরবি উচ্চারণ: [ʔaħadiːθ], আক্ষরিক অর্থে "কথা" বা "বক্তৃতা") বা আসার (আরবি: أثر‎‎, ʾAṯar, 

আক্ষরিক অর্থে "ঐতিহ্য")[৪] বলতে বোঝায় ইসলামি নবি মুহাম্মদের যে কথা, কাজ ও নীরব অনুমোদন বর্ণনাকারীদের শৃঙ্খলের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছে বলে অধিকাংশ মুসলিম বিশ্বাস করে। অন্য কথায়, মুহাম্মাদ কি বলেছিলেন এবং কি করেছিলেন সে সম্পর্কে হাদিসটি প্রেরণ করা হয়েছে।

হাদিস পবিত্র আল-কুরআনের ব্যাখ্যা সরূপ,

"তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্যে আপনি দ্রুত ওহী আবৃত্তি করবেন না। এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমাদের দায়িত্ব। অতঃপর আমি যখন তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন। এরপর তা ব্যাখ্যা করা আমাদের দায়িত্ব।[৫]

সূরা আল-ক্বিয়ামাহ, আয়াত: ১৬-১৯ "[৬]


আরো খবর



এমাদ হামদেহ যেমন উল্লেখ করেছেন,[৭] প্রতিটি প্রতিবেদনই মুহাম্মদ সম্পর্কে তথ্যের একটি অংশ; যখন সংগ্রহ করা হয়, তখন এই তথ্য একটি বড় চিত্রের প্রতি নির্দেশ করে যাকে সুন্নাহ বলা হয়।

হাদিসকে ইসলামি সভ্যতার "মেরুদন্ড" বলা হয়েছে,[৮] এবং ইসলামের মধ্যে ধর্মীয় আইন এবং নৈতিক দিকনির্দেশনার উৎস হিসাবে হাদিসের কর্তৃত্ব কুরআনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে[৯] (যাকে মুসলিমরা এই শব্দ বলে মনে করে মুহাম্মাদকে আল্লাহর কাছে অবতীর্ণ করা হয়েছে। 

অধিকাংশ মুসলিম বিশ্বাস করে যে হাদিসের জন্য শাস্ত্রীয় কর্তৃত্ব এসেছে কুরআন থেকে, যা মুসলিমদের মুহাম্মদকে অনুকরণ করতে ও তার রায় মেনে চলতে নির্দেশ দেয়

(যেমন ২৪:৫৪, ৩৩:২১ আয়াতে)।

যদিও কুরআনে আইন সম্পর্কিত আয়াতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, হাদিস ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার বিবরণ (যেমন গোসল বা অজু, নামাজের জন্য অজু)[১০] থেকে শুরু করে সালাতের সঠিক ধরন[১১] এবং দাসদের প্রতি দানশীলতার গুরুত্ব পর্যন্ত সবকিছুর নির্দেশনা দেয়।[১২] এইভাবে শরীয়তের (ইসলামি আইন) নিয়মের "বৃহৎ অংশ" কুরআনের পরিবর্তে হাদিস থেকে নেওয়া হয়েছে।[১৩][টীকা ১]


হাদীস সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস


সাহাবীগণ ইসলামের সর্বশেষ নবীর কথা ও কাজের বিবরণ অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে স্মরণ রাখতেন। আবার কেউ কেউ তার অনুমতি সাপেক্ষে কিছু কিছু হাদীস লিখে রাখতেন।

 এভাবে তার জীবদ্দশায় স্মৃতিপটে মুখস্থ করে রাখার সাথে সাথে কিছু হাদীস লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ ছিল। হযরত আলী, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আনাস ইবনে মালিক প্রমুখ সাহাবীগণ কিছু কিছু হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। 

হযরত আবূ হুরায়রা বলেন “আবদুল্লাহ ইবনে আমর ব্যতীত আর কোন সাহাবী আমার অপেক্ষা অধিক হাদীস জানতেন না। কারণ, তিনি হাদীস লিখে রাখতেন আর আমি লিখতাম না।”

নবীর জীবদ্দশায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনিক বহু কাজকর্ম লিখিতভাবে সম্পাদনা করা হতো। বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা, সরকারী কর্মচারী এবং জনসাধারনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত নির্দেশ প্রদান করা হতো। 

তাছাড়া রোম, পারস্য প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশসমূহের সম্রাটদের সাথে পত্র বিনিময়, ইসলামের দাওয়াত এবং বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের সাথে চুক্তি ও সন্ধি লিখিতভাবে সম্পাদন করা হতো। আর ইসলামের নবীর আদেশক্রমে যা লেখা হতো তাও হাদীসের অন্তর্ভুক্ত। 

ইসলামের নবীর মৃত্যুর পর বিভিন্ন কারণে হাদীস সংকলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কুরআন মাজীদের সাথে হাদীস সংমিশ্রণ হওয়ার আশংকায় কুরআন পুর্ণ গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত হাদীস লিপিবদ্ধ করতে কেউ সাহস পায়নি।

 আবূ বকরের আমলে কুরআন মাজীদ গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হলে সাহাবীগণ হাদীস লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে আর কোন বাধা আছে বলে অনুভব করেননি। হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে সাহাবি ও তাবেয়ীগণ প্রয়োজন অনুসারে কিছু হাদীস লিপিবদ্ধ করেন।

অতঃপর উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয হাদীস সংগ্রহের জন্য মদীনার শাসনকর্তা আবু বকর বিন হাজম সহ মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা ও আলিমগণের কাছে একটি ফরমান জারী করেন যে, আপনারা মহানবী হাদীসসমূহ সংগ্রহ করুন।

 কিন্তু সাবধান! মহানবী এর হাদীস ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করবেননা। আর আপনার নিজ নিজ এলাকায় মজলিস প্রতিষ্ঠা করে আনুষ্ঠানিকভাবে হাদীস শিক্ষা দিতে থাকুন। কেননা, জ্ঞান গোপন থাকলে তা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়।

 এই আদেশ জারীর পর মক্কা, মদীনা, সিরিয়া, ইরাক এবং অন্যান্য অঞ্চলে হাদীস সংকলনের কাজ শুরু হয়। কথিত আছে যে, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে শিহাব আল-জুহরি সর্বপ্রথম হাদীস সংগ্রহ এবং সংকলনে হাত দেন। কিন্তু তার সংকলিত হাদীসগ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 এরপর ইমাম ইবনে জুরাইজ মক্কায়, ইমাম মালিক মদীনায়, আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব মিসরে, আব্দুর রাজ্জাক ইয়েমেনে, আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক খুরাসানে, এবং সূফিয়ান সাওরী ও হাম্মাদ ইবনে সালমা বসরায় হাদীস সংকলনে আত্ননিয়োগ করেন।

 এ যুগের ইমামগণ কেবল দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় হাদীসগুলো ও স্থানীয় হাদীস শিক্ষাকেন্দ্রে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাদের কেউই বিষয়বস্তু হিসেবে বিন্যাস করে হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করেননি।

এ যুগে লিখিত হাদীস গ্রন্থসমূহের মধ্যে ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান প্রামান্য হাদীসগ্রন্থ। ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” গ্রন্থটি হাদীস সংকলনের ব্যাপারে বিপুল-উৎসাহ উদ্দিপনার সৃষ্টি করেছিল।

 এটি হাদীসশাস্ত্র অধ্যায়নে মুসলিম মণিষীদের প্রধান আর্কষণে পরিণত হয়েছিল। এরই ফলশ্রূতিতে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে সর্বত্র হাদীস চর্চার কেন্দ্র কিতাবুল “উম্ম” এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের “মাসনাদ” গ্রন্থদ্বয় হাদীসের উপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।

 অতঃপর হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে অনেক মুসলিম মণিষী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর হাদীস সংগ্রহ করেন। তন্মধ্যে বিখ্যাত হলেন ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ, এবং ইমাম ইবনে মাজাহ।

 এদের সংকলিত হাদীস গ্রন্থগুলো হলো সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ, সুনান আত-তিরমিজী, সুনানে নাসাই এবং সুনানে ইবনে মাজাহ। এই ছয়খানা হাদীসগ্রন্থকে সন্মিলিতভাবে সিহাহ সিত্তাহ বা ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ বলা হয়। আব্বাসিয় যুগে হাদীস লিপিবদ্ধের কাজ পরিসমাপ্ত হয়।[২৯]

ইসলামে হাদিস সংরক্ষণ ও বর্ণনা



ইসলামে হাদিস সংরক্ষণ মূলত বর্ননা transfer ও গ্রহন এর সাথে সম্পর্কিত।

এখানে বর্ননা transfer মূলত এক দল কেন্রিক (যারা সত্য পথ দেখায়), যারা ন্যায়বিচার এর মাধ্যমে যাচাই বাছাই (তাহকীক)[৩৮] কেন্দ্রিক [৩৯]সত্য প্রতিষ্টা করে অন্যান্যদের কাছে।

وَمِمَّنۡ خَلَقۡنَاۤ اُمَّۃٌ یَّہۡدُوۡنَ بِالۡحَقِّ وَبِہٖ یَعۡدِلُوۡنَ ٪

অর্থঃ এবং তাদের থেকে[৪০] আমরা সৃষ্টি করেছি, এক দল, যারা সত্য পথ দেখায় এবং সে অনুযায়ী ন্যায়চিার করে। [সূরা আল আরাফ, আয়াত: ১৮১][৪১]

এই দল এর ক্রমধারা সাহাবাদের থেকে শুরু হয়ে হাদিস সংরহ্মণ হচ্ছে, এই দল এর বৈশিষ্ট্য হলো, তারা সত্য পথ দেখায় এবং সে অনুযায়ী ন্যায়চিার করে।

এই দল এর মাধ্যমেই ইসলাম প্রত্যেক প্রজন্মে এসেছে ও বিস্তার ঘটে, হাদিস সংরক্ষিত ও প্রচার হচ্ছে ।[৪২]

"তিনিই নিরক্ষরদের মাঝে পাঠিয়েছেন তাঁর রসূলকে তাদেরই মধ্য হতে, যে তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত আবৃত্তি করে, তাদেরকে পবিত্র করে ও তাদেরকে শিক্ষা দেয় নিদিষ্ট কিতাব এবং নির্দিষ্ট প্রঙ্গা। যদিও ইতোপূর্বে তারা ছিল অবশ্যই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে।[৪৩]

এবং তাদের থেকে অন্যান্য, যারা যোগ হয় নাই তাদের সাথে এখনও। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
[৪৪]" [সূরা আল জুমুয়াহ, আয়াত ২-৩]

হাদীসে বলা হয়েছে,

আল্লাহ পাক সেই ব্যক্তিকে সতেজ, ও সমুজ্জ্বল রাখুন, যে আমার কথাগুলো শুনেছে, সংরক্ষণ করেছে এবং অপরজনের নিকট তা পৌঁছে দিয়েছে। (আবু দাউদ)[হাদিস নম্বর প্রয়োজন]

বলা হয়, যে ব্যক্তি মূলত অর্থেই হাদিস সন্ধানী হয় তার চেহারা সজীব বা নুরানি হয়ে ফুটে ওঠবে। অন্য হাদিসে বলা হয়েছে,

হে আল্লাহ, আমার উত্তরসূরিদের প্রতি রহম করুন। সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুাল্লাহ! আপনার উত্তরসূরি কারা? তিনি বলেন, তারাই যারা আমার হাদিস বর্ণনা করে ও মানুষের নিকট শিক্ষা দেয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

হাদিসে বলা হয়েছে,
“নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন তারাই আমার নিকটবর্তী হবে যারা অধিক হারে আমার প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করে।” (তিরমিজি)

এই হাদিসটি ইবনে হিব্বান তার হাদিসের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং বলেছেন এই হাদিস এর ফায়েজ ও বরকত লাভ করবে নিশ্চিতভাবে মুহাদ্দিসানে কেরাম ও হাদিসের শায়খগণ।

 কারণ তারাই অধিক হারে হাদিস পড়ে, লিখে। যতবার হাদিস লিখবে বা পড়বে ততবার তিনি প্রিয়নবীর প্রতি দরূদ সালাম পড়বেন ও লিখবেন। এর ফলে রোজ কিয়ামতে সহজেই তারা প্রিয়নবীর নিকটবর্তী হতে পারবেন। [৪৫]:

কিতাবুস সিত্তাহ


কিতাব কথাটি কিতাব كتاب থেকে আগত, যার অর্থ বই। আর আল-সিত্তাহ السته হচ্ছে ৬টি। ইসলামী পরিভাষায় হাদিসের ছয়খানা অন্যতম হাদিসগ্রন্থকে একত্রে কিতাবুস সিত্তাহ বলে।

কিতাবুস সিত্তাহ গ্রন্থাবলি ও এর সংকলকদের নাম
ক্রমিক নংগ্রন্থের নামসংকলকের নামজন্মওফাতজীবন কালহাদিস সংখ্যা
সহীহ বুখারীমুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহিম ইবনে মুগিরা১৯৪ হিজরি ১৩ শাওয়াল,৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুলাই২৫৬ হিজরি৬২ বছর৭৩৯৭টি
সহীহ মুসলিমমুসলিম ইবনে হাজ্জাজ আল কুশায়রি আল নিশাপুরী২০৪ হিজরিতে নিশাপুরে২৬১ হিজরি৫৭ বছর৪০০০টি
জামি' আত তিরমিজিআবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিজি২০৯ হিজরিতে খোরাসানের তিরমিজ শহরে২৭৯ হিজরি৭০ বছর৩৮১২টি
সুনানে আবু দাউদআবু দাউদ সুলায়মান ইবনে আশআশ ইবনে ইসহাক২০২ হিজরিতে সিস্তান নামক স্থানে২৭৫ হিজরি৭৩ বছর৪৮০০টি
সুনানে নাসাইইমাম আবু আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শুআইব ইবনে আলি আল খোরাসানি আন-নাসাই২১৫ হিজরি নাসা শহরে৩০৩ হিজরি৮৮ বছর৫৭৬১ টি
সুনানে ইবনে মাজাহআবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাযাহ আল কাজবিনি২১৭ হিজরিতে কাসবিন শহরে২৭৩ হিজরি৬৪ বছর৪৩৪৯টি

হাদিস গ্রন্থের তালিকা

সর্বোচ্চ হাদিস বর্ণনাকারী কয়েকজন সাহাবী


হাদীস উদ্ধৃতকারী সাহাবীগণ
ক্রমিক নংসাহাবীর নামওফাতজীবন কালবর্ণিত হাদিসের সংখ্যা
হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.) (প্রকৃত নামঃ আবদুর রহমান)৫৭ হিজরি৭৮ বছর৫৩৭৪ টি
উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)৫৮ হিজরি৬৭ বছর২২১০টি
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)৬৮ হিজরি৭১ বছর১৬৬০টি
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)৭০ হিজরি৮৪ বছর১৬৩০টি
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)৭৪ হিজরি৯৪ বছর১৫৪০টি

হাদিস শাস্ত্রের কতিপয় পরিভাষা

সাহাবী (صحابى)

যেসব ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ইসলামের নবীর সাহচর্য লাভ করেছেন বা তাকে দেখেছেন ও তার একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, অথবা জীবনে একবার তাকে দেখেছেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে সাহাবী বলা হয়।

তাবিঈ (تابعى)

যারা ইসলামের নবীর কোনো সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা তাকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে তাবিঈ বলা হয়।

মুহাদ্দিস (محدث)

যে ব্যক্তি হাদিস চর্চা করেন এবং বহুসংখ্যক হাদিসের সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাকে মুহাদ্দিস বলা হয়। [টীকা ২]

শায়খুল হাদিস

হাদিস শাস্ত্রে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী, দীর্ঘ দিন হাদিসের পঠন ও পাঠনে নিরত শায়খকে ‘শায়খুল হাদিস’ বলা হয়। ভারত উপমহাদেশে সহীহ বুখারি পাঠদানকারীকে ‘শায়খুল হাদিস’ বলা হয়।[৪৬]

শায়খ (شيخ)

হাদিসের শিক্ষাদাতা রাবীকে (বর্ণনাকারীকে) শায়খ বলা হয়।

শাইখাইন (شيخين)

সাহাবীগণের মধ্যে আবু বকর ও উমরকে একত্রে শায়খায়ন বলা হয়। কিন্তু হাদিসশাস্ত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমকে এবং ফিক্হ-এর পরিভাষায় ইমাম আবু হানিফা ও আবু ইউসুফকে একত্রে শায়খায়ন বলা হয়।

হাফিজ (حافظ)

যিনি সনদ ও মতনের বৃত্তান্ত সহ এক লক্ষ হাদিস আয়ত্ত করেছেন তাকে হাফিজ বলা হয়।

হুজ্জাত (حجة)

যিনি তিন লক্ষ হাদিস আয়ত্ত করেছেন তাকে হুজ্জাত বলা হয়।

হাকিম (حاكم)

যিনি সব হাদিস আয়ত্ত করেছেন তাকে হাকিম বলা হয়।

রিজাল (رجال)

হাদিসের রাবি সমষ্টিকে রিজাল বলে। যে শাস্ত্রে রাবি বা বর্ণনাকারীদের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে তাকে আসমাউর-রিজাল (اسماء الرجال) বলা হয়।

রিওয়ায়ত (رواية)

হাদিস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়ত বলে। কখনও কখনও মূল হাদিসকেও রিওয়ায়ত বলা হয়। যেমন, এই কথার সমর্থনে একটি রিওয়ায়ত (হাদিস) আছে।

সনদ (سند)

হাদিসের মূল কথাটুকু যে সূত্র পরম্পরায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে সনদ বলা হয়। এতে হাদিস বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে।

মতন (متن)

হাদিসের মূল কথা ও তার শব্দ সমষ্টিকে মতন বলে।

মরফু’ (مرفوع)

যে হাদিসের সনদ (বর্ণনা পরম্পরা) ইসলামের নবী পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মরফু’ হাদিস বলে।

মাওকুফ (موقوف)

যে হাদিসের বর্ণনা-সূত্র ঊর্ধ্ব দিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে, অর্থাৎ যে সনদ-সূত্রে কোনো সাহাবীর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে তাকে মাওকুফ হাদিস বলে। এর অপর নাম আসার (اثار) ।

মাকতু (مقطوع)

যে হাদিসের সনদ কোনো তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মাকতু’ হাদিস বলা হয়।

মুত্তাফাকুন আলাইহি (متفق عليه)

যে হাদিসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ই একমত এবং তারা উক্ত হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন তাই মুত্তাফাকুন আলাইহি হাদিস।

সহিহ (ﺻﺤﻴﺢ )

যে মুত্তাসিল হাদিসের সনদে উল্লেখিত অর্থাৎ (ইত্তেসালে সনদ, জাবত, আদালত, সাজ না হওয়া, দোষ মুক্ত হওয়া,) প্রত্যেক বর্ণনাকারীই পূর্ণ আদালত ও জাবতা-গুণসম্পন্ন এবং হাদিসটি যাবতীয় দোষত্রুটি মুক্ত তাকে সহিহ হাদিস বলে।

হাসান (حسن)

যে হাদিসের কোনো বর্ণনাকারীর জারতগুণে পরিপূর্ণতার অভাব রয়েছে তাকে হাসান হাদিস বলা হয়। ফিকহবিদগণ সাধারণত সহিহ ও হাসান হাদিসের ভিত্তিতে শরিয়তের বিধান নির্ধারণ করেন।

যয়িফ ( ﺿﻌﻴﻒ)

যে হাদিসের বর্ণনাকারী কোনো হাসান হাদিসের বর্ণনাকারীর গুণসম্পন্ন নন তাকে যয়িফ/য'ইফ/ জইফ হাদিস বলে।

মাওজু’ (موضوع)

যে হাদিসের বর্ণনাকারী জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলামের নবীর নামে মিথ্যা কথা রটনা করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার বর্ণিত হাদিসকে মাওজু’ হাদিস বলে। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করা হয় না।

কুদসি’ (حديث قديس)

যে সকল হাদিসকে ইসলামের নবী (হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বানী বলে উল্লেখ করেছেন, যা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত নয়, সেগুলোকে হাদিসে কুদসি বলা হয়।


সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গি


হাদীসের প্রকারভেদ

মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫টি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহীহ হাদীস বলা হয় -

  1. হাদীসের সকল বর্ণনাকারী সৎ ও বিশ্বস্ত
  2. বর্ণনাকারীদের নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা পূর্ণরূপে বিদ্যমান
  3. প্রত্যেক বর্ণনাকারী তার ঊর্ধ্বতন বর্ণনাকারী থেকে হাদীসটি স্বকর্ণে শুনেছেন বলে প্রমাণিত
  4. অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমাণিত
  5. সনদগত বা অর্থগত কোনো সূক্ষ্ম ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত

দ্বিতীয় শর্তে সামান্য দুর্বলতা থাকলে হাদীসটি হাসান বলে গণ্য হতে পারে। শর্তগুলোর অবর্তমানে হাদীসটি যয়ীফ বা দুর্বল অথবা মাউযূ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য হতে পারে।[৪৭] ইসলামে দুর্বল ও বানোয়াট হাদীস আকীদার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।তবে সালাফে সালেহীনগণ (সাহাবী,তাবেয়ী,তাবে-তাবেয়ী) দূর্বল হাদিসের উপর আমল করেছেন প্রমাণ পাওয়া গেলে আমল করতে অসুবিধা নেই।


সহিহ হাদীসের প্রকারভেদ

বর্ণনাকারীদের সংখ্যার দিক থেকে মুহাদ্দিসগণ সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীসকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন -

  1. যেসকল হাদীস সাহাবীগণের যুগ থেকে সংকলন পর্যন্ত সকল স্তরে অনেক বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন তাকে মুতাওয়াতির বা অতি প্রসিদ্ধ হাদীস বলা হয়।
  2. যেসকল হাদীস সাহাবীগণের যুগ থেকে সংকলন পর্যন্ত কোনো যুগে অল্প কয়েকজন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন তাকে আহাদ বা খাবারুল ওয়াহিদ হাদীস বলা হয়।

আকীদার ক্ষেত্রের মুতাওয়াতির বা অতি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যায়। অন্যদিকে খাবারুল ওয়াহিদ হাদীস দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা না গেলেও তা কার্যকর ধারণা প্রদান করে। কর্ম বিষয়ক বৈধ, অবৈধ ইত্যাদি বিধিবিধানের ক্ষেত্রে এই ধরনের হাদীসের উপরে নির্ভর করা হয়। 

আকীদার মূল বিষয় প্রমাণের জন্য সাধারণত এরূপ হাদীসের উপর নির্ভর করা হয় না। তবে মূল বিষয়ের ব্যাখ্যায় এর উপর নির্ভর করা হয়।

কুরআনে উল্লেখিত বা মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমে জানা কোনো বিষয় অস্বীকার করলে তা কুফরী হিসেবে গণ্য হয়। আর খাবারুল ওয়াহিদের মাধ্যমে জানা বিষয় অস্বীকার করলে তা বিভ্রান্তি হিসেবে গণ্য হয়।

 মুসলিমরা বিশ্বাস করে কুরআন পুরোপুরিই মুতাওয়াতির ভাবে বর্ণিত। কেউ একটি শব্দকেও সমার্থক কোনো শব্দ দিয়ে পরিবর্তন করেন নি। অন্যদিকে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবী তাবিয়ীগণ অর্থের দিকে বেশি লক্ষ্য রাখতেন।

 তারা প্রয়োজনে একটি শব্দের পরিবর্তে সমার্থক অন্য শব্দ ব্যবহার করতেন।[৪৭]

বিশুদ্ধ হাদীসের উৎস

অল্প সংখ্যক মুহাদ্দিস কেবলমাত্র সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও আলিম সনদসহ হাদীস উল্লেখ করলেও হাদীসটি কোন স্তরের তা বলার প্রয়োজন মনে করতেন না।

আল্লামা ইবনুস সালাহ বলেন -

বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থের বাইরে সহীহ হাদীস খুঁজতে হবে মাশহুর হাদীসের গ্রন্থগুলোতে, যেমন - আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু খুযাইমা, দারাকুতনী ও অন্যান্যদের সংকলিত গ্রন্থ। তবে এ সকল গ্রন্থে যদি কোনো হাদীস উদ্ধৃত করে তাকে সুস্পষ্টত 'সহীহ' বলে উল্লেখ করা হয় তবেই তা সহীহ বলে গণ্য হবে, শুধুমাত্র এ সকল গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে বলেই হাদীসটিকে সহীহ মনে করা যাবে না। কারণ এ সকল গ্রন্থে সহীহ এবং যয়ীফ সব রকমের হাদীসই রয়েছে।

 

আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী বলেন -

দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল যুগের অধিকাংশ মুহাদ্দিসের রীতি ছিল যে, সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ, বাতিল সকল প্রকার হাদীস সনদসহ সংকলন করা। তাঁদের মূলনীতি ছিল যে, সনদ উল্লেখ করার অর্থই হাদীসটি বর্ণনার দায়ভায় বর্ণনাকারীদের উপর ছেড়ে দেয়া, সংকলকের আর কোনো দায় থাকে না।


আমিন।

                                                         source: wikipedia.










No comments:

Post a Comment