লাভ বেশি শেয়ারবাজারে, তবে...........!!!!!

 

ব্যবসার মধ্যে এক অর্থে সবচেয়ে সহজ-সরল হল শেয়ারবাজারের কারবার। তাগড়া পুঁজি থাকলে আর কিছু লাগে না-কেউ দেখবে না, কেউ জানবে না, নীরবে ঘরে বসে মানুষের সংস্পর্শ ও কায়িক শ্রম ছাড়াই অনায়াসে আপনি কোটি কোটি টাকার লেনদেন চালিয়ে যেতে পারেন। এ জাতীয় বিষয়বাসনা বাস্তবায়নে বাইরে যেতে হয় না, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পিছে নিত্যদিন লেগে থাকতে হয় না।

আবার অন্য বিবেচনায়, এ একই কাজ দুনিয়ার তামাম তেজারতি থেকে জবর কঠিন, জবর ঝুঁকিপূর্ণ! বিধিবাম হলে কোনো নোটিশ ছাড়াই সামান্য এক ছুঁতোয় হঠাৎ বাজারে ধস নামতে পারে এবং মাত্র কয়েকদিন কিংবা কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে আপনি সর্বস্ব হারিয়ে মনোবৈকল্যের মহাসাগরে হাবুডুবু খেতে পারেন। আপনার মর্মজ্বালা আপনি কাউকে কইতেও পারবেন না, আবার সইতেও পারবেন না। রহস্যজনক শেয়ারবাজারের ব্যবসা নিয়েই আমার আজকের এ রচনা।


আমাদের মতো আনাড়ি লোক, যারা নতুন এ ব্যবসায় আসে-তাদের বেশিরভাগই তরল বিনিয়োগের সবচেয়ে প্রাথমিক এবং মৌলিক বিষয়টিই বুঝে না। প্রশ্নটি হল, ‘শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য কী?’ একশ’জন বিনিয়োগকারীকে যদি এ প্রশ্ন করেন, অন্তত ৯০ জনই উত্তর দেবে-‘মুনাফা’, যা একেবারেই ঠিক নয়। কোম্পানি-স্টক নাড়াচাড়া এতই স্পর্শকাতর, বায়বীয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ; যা সাধারণ চোখে দেখা যায় না এবং সাধারণ বুদ্ধিতে অনুমানও করা যায় না।

এ বাজারে একজন প্রাপ্তবয়স্ক বিনিয়োগকারীর কেনাবেচার সঙ্গে একটি সরল শিশুর আগুন নিয়ে খেলার কোনো তফাত নেই। জ্বলন্ত আগুনের শিখায় একখানা কাগজি টাকার নোট ফেলে দিয়ে যেমন নিখুঁত অবস্থায় তুলে আনা যায় না, ঠিক তেমনি শেয়ারবাজারে পুঁজি বিনিয়োগ করে, কিছু না-খুইয়ে পুরোটার পুনরুদ্ধারও প্রায় অসম্ভব। অভিজ্ঞজনরা বলেন, ‘এ ব্যবসায় বিনিয়োগ করার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হল, পুঁজির ‘হেফাজত’।

‘মুনাফা’ হল দ্বিতীয় লক্ষ্য। যেসব বিনিয়োগকারী পুঁজির নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে মুনাফার পেছনে দৌড়ে, তারা সহজেই বুঝতে পারে, স্টক মার্কেটের আগুন কেবল যে পুঁজিই পোড়ায় তা নয়; সময় সময় করিৎকর্মার মনে এমন এক তুষের আগুন ধরিয়ে দেয়, যা থেকে ধোঁয়াও ওড়ে না, আলোও জ্বলেও না এবং এ অনলের জ্বালা পানি কেন, বরফ দিয়েও নেভানো যায় না।

এখন কথা হল, শেয়ারবাজারে কীভাবে পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়? দুঃসংবাদ হল, এ সার্বজনীন সওয়ালের সহজ-সরল-সঠিক জওয়াব জগতের কোনো কেতাবে পাওয়া যায় না। কোনো অসাধারণ প্রতিভাবান আদমসন্তানের মগজে থাকলেও সে কাউকে মুখ ফুটে বলবে না। এ অবস্থায় নিজের সীমিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞজনের বয়ান শুনে যেটুকু বুঝেছি, তার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আমি একটি কৌশল তৈরি করেছি।

শেয়ার ব্যবসায় আমার কথাগুলো যে একমাত্র কথা এবং সব কথার শেষ কথা, এমনটি আদৌ ঠিক নয় এবং আমি তা দাবিও করি না। আমি যা বলব, তার প্রতিটি কথা আপনি আপনার ‘এলেম’, ‘আমল’ এবং ‘আক্কেল’ দিয়ে পরখ করে নেবেন। আমার কথাগুলো একটু কাটা কাটা এবং কঠিন বিধায় অনেকের কাছে পছন্দ নাও হতে পারে। এবার আসি আসল কথায়।

প্রথমত, শেয়ারবাজারে ব্যবসা করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন বিসমিল্লাতেই মন থেকে ঝেড়ে-মুছে ছুড়ে ফেলে দিন। এ ব্যবসায় চূড়ান্ত ফল পেতে হলে দীর্ঘদিন ইন্তেজার করতে হবে। যদি সেই ধৈর্য এবং বয়স না থাকে, তা হলে আমার মতে আপনি নিরাপদ শেয়ার ব্যবসার জন্য তৈরি নন। স্বল্প কিংবা মধ্যমেয়াদে টুকটুক করে শেয়ার কেনাবেচা করে নিয়মিত টাকা কামাই করবেন, আপনার সেই সোনালি আশার ‘গুড়ের’ সঙ্গে এখনই একগাদা ‘বালু’ মিশিয়ে দিন।

শেয়ার কেনাবেচার বিষয়ই নয়। এটি একান্তই একটা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ; কিনে বসে থাকবেন। দীঘিতে রুই-কাতলা ধরার জন্য বড়শি ফেলে যেভাবে সুবোধ বালকের মতো বসে থাকেন, সেভাবে ধীরস্থির হয়ে ঠায় বসে থাকবেন। কতদিন বসে থাকবেন? কমসে কম ৩০ বছর। এর মাঝে টাকার দরকার হলে কি কিছু বেচতে পারবেন না?

হ্যাঁ, পারবেন- তবে কাঁচা টাকা গোনার জন্য নয়। যদি এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যৌক্তিক পারিবারিক কারণ থাকে, অবশ্যই স্টক বেচতে পারবেন- যেমন বাড়ি বানাবেন, গাড়ি কিনবেন, ছেলেমেয়ের বিয়ে দেবেন ইত্যাদি কারণে স্টক বিক্রি করে সম্পদ তরলায়িত করা জায়েজ আছে। যার বয়স ৫০ পার হয়ে গেছে, তিনিও শেয়ার ব্যবসা করতে পারবেন, তবে নিজের জীবদ্দশায় এর সত্যিকারের সুফল ভোগ করার সুযোগ নাও পেতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, এ ব্যবসায় আসার আগে থেকেই ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’ বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ, হাওলাত করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার কথা ভুলেও ভাববেন না। নিজের সঞ্চয়ের সেই অংশটিই শেয়ার ব্যবসায় খাটাবেন, যার ষোলআনা খোয়া গেলেও আপনার কিংবা আপনার পরিবারের জীবনমানের ওপর কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। ‘পোর্টফলিও’র বিপরীতে প্রান্তিক ঋণ নিয়েও কোনো স্টক কিনবেন না, একেবারেই না।

‘ডিরাইভেটিভ প্রডাক্ট’-এর কথা জানা থাকলে তা ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। ‘অপশন’ কেনাবেচা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। ‘শর্ট’ পজিশনেও যাবেন না। নগদ টাকা দিয়ে স্টক কিনুন। ‘লং’ পজিশন নিয়ে নিরাপদে নিশ্চিন্তে বসে থাকুন, শান্তিতে ঘুমান, বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখুন।


এবার পরের প্রশ্ন, আপনার সঞ্চিত পুঁজির কতটা বিনিয়োগ করবেন? আপনার যা পুঁজি আছে, তার ১-৪ দিয়ে শুরু করুন। মওকা বুঝে আস্তে আস্তে আরও বাজারে ঢালুন, তবে সব সময় নজর রাখবেন-যত টাকা বিনিয়োগে থাকবে, তার প্রায় সমপরিমাণ নগদ টাকা আলাদা করে রাখুন, যাতে বাজার হঠাৎ পড়লে আপনি নতুন স্টক কিনে সুযোগ নিতে পারেন। মনে রাখবেন, ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘Cash is king.’ স্টক পড়লে যদি কিনতে না পারেন, তাহলে এ অভিনব ব্যবসায় আপনি খুব একটা এগোতে পারবেন না।

তৃতীয়ত, কী কিনবেন? এর আগে বলেছি-কী কিনবেন না। মনে রাখবেন, কোনো অবস্থায়ই কোনো বিশেষ কোম্পানির স্টক (Individual company stock) কিনবেন না, সে যতই লাভজনক ও আকর্ষণীয় হোক না কেন। কারণ, বাজার যখন পড়ে, তখন কড়কড় শব্দে ঝড়ের রাতে গাছের ডালের মতো সবই ভেঙে পড়ে; কিন্তু যখন উঠে তখন সবই যে উঠে কিংবা সমপরিমাণে ওঠে-তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আপনি বিশেষ কোনো কোম্পানির সঙ্গে আপনার ভাগ্যকে জড়াবেন না। আপনি থাকবেন গোটা শেয়ারবাজারের সঙ্গে।

কারণ, বাজার পড়লে দু’দিন আগে আর পরে বাজার অবশ্যই উঠবে। এর বিপরীতে বিশেষ কোম্পানি-স্টক পড়ে পড়ে হাওয়াও হয়ে যেতে পারে। দশটা স্টক লাভ দিতে পারে; কিন্তু একটাই আপনাকে পথে বসিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সে জন্য আপনি বিনিয়োগ করবেন ‘মিউচুয়াল ফান্ডে’ এবং ‘ইনডেক্স ফান্ডে’, যেমন- QQQ, DIA, SPY, SPYD ইত্যাদি। আবারও বলছি, Individual stock-এ কখনও বিনিয়োগ করবেন না। বাংলাদেশে ‘ইনডেক্স ফান্ড’ ও ‘মিউচুয়াল ফান্ডের’ শেয়ার কেনাবেচা হয় কি না, জানি না। না হলে সেখানে আমার কৌশল কাজে লাগবে না।

চতুর্থত, একটি কথা মনে রাখবেন, শেয়ারবাজার ওঠানামার পেছনে বাজারে অংশগ্রহণকারীদের দুটো মনস্তত্ত্ব কাজ করে। তার একটি হল লালসা এবং আরেকটি ভীতি। বিনিয়োগকারীরা এক সময় লোভে পড়ে ডান-বাম না ভেবে অনবরত স্টক কিনতে থাকে আর বাজার ওপরের দিকে উঠতে থাকে। লোভ যখন বাস্তবতার সীমারেখা ছাড়িয়ে যায়, তখন বাজার হয় অতি মূল্যায়িত। অতি মূল্যায়িত বাজার অবধারিতভাবে সামান্য অজুহাতে আপন প্রক্রিয়ায় তাকে সংশোধন করে নেয়, ইংরেজিতে যাকে বলে- Market correction. এটি যতদিন চলতে থাকে, ততদিন নির্দয়ভাবে শেয়ারবাজারে দর পড়তে থাকে।


আরো পড়ুন : অসহনীয় অনবরত হাঁচি থেকে মুক্তি পেতে


এ পর্যায়ে দরপতন ছোট গল্পের মতো, ‘শেষ হয়েও হয় না শেষ’। এ রকম সময়ে, মার খেতে খেতে বিনিয়োগকারীদের মন থেকে ‘লোভ’ পালিয়ে যায় ঠিকই; কিন্তু ‘আতঙ্ক’ এসে শক্তভাবে বাসা বাঁধে। এবার ভয়ে তারা বাজারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ধরে নেয়, বাজার আরও পড়বে- ফলে, শেষ সম্বল যেটুকু স্টক হাতে থাকে, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তা-ও ছ’কড়া ন’কড়া দামে ছেড়ে দিয়ে, অবসাদগ্রস্ত হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে।

ইংরেজিতে যাকে বলে Complete market capitulation. এ সময় বাজার দর নেমে আসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। আর এটি হল স্টক কেনার মোক্ষম সময়। এ সময়টাকে যে চিনতে পারে, ধরতে পারে এবং সাহসের সঙ্গে ইনডেক্স ফান্ড কিনতে পারে, সে যেন জিতে গেল লক্ষ-কোটি টাকার লটারি।

পঞ্চমত, Bull market-এ যখন শনৈ শনৈ স্টক উঠতে থাকে তখন মানুষ আনন্দে আর উত্তেজনায় স্টক বিক্রি করে লাভ ঘরে তুলে আনে। আপনি ধৈর্য ধরে বসে থাকুন, আপনি লাভের লোভে স্টক বেচবেন না; বরং নতুন নতুন সঞ্চয় থেকে টাকা এনে জমা করতে থাকুন, যাতে মওকা ধরতে পারেন। মনে রাখবেন, শেয়ারবাজারের ব্যবসার আসল মজা ‘উড়ন্ত’ বাজারে (Bull market-এ) নয়; বরং ‘পড়ন্ত’ বাজারে (Bear market-এ)।

আনুমানিক প্রতি দশ বারো বছর অন্তর অন্তর আপনি একটি স্বর্ণসুযোগ পাবেন। অর্থাৎ, স্টক মার্কেট ৩০-৫০ শতাংশ পড়ে যাবে। এ পড়ে যাওয়ার সময় যদি আপনি স্টক কিনতে পারেন, তা হলে মনে করবেন আপনি ‘দাও’ মেরে দিয়েছেন! যখন স্টক-মার্কেট পড়তে থাকে, তখন মানুষ হায় হায় করে ভয়ে বেঁচে দেয়।


আরো পড়ুন : যেসব লক্ষণ দেখলে বুঝবেন যে আপনি থাইরয়েডের শিকার !!!


এ রকম সময়ে আপনি ধীরস্থিরভাবে খুশিমনে খালি কিনতে থাকুন। মার্কেট ১০ শতাংশ পড়ে, আপনি ২০ শতাংশ নতুন পুঁজি বাজারে ঢালুন, মার্কেট ২০ শতাংশ পড়ে, আপনি ৪০ শতাংশ নতুন পুঁজি কাজে লাগান। এভাবে স্তরে স্তরে স্টক কিনতে থাকুন। যখন পুঁজি শেষ হয়ে যাবে, তখন হাত-পা গুটিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকুন, ধারকর্জ করবেন না, অস্থির হবেন না। আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, ইনডেক্স ফান্ড ছাড়া Individual

stock কিনবেন না। আপনি যত গভীরে যত বেশি কিনতে পারবেন, ততই এগিয়ে থাকবেন। আপনি মার্কেটের সঙ্গে থাকলে এক সময় দেখবেন মার্কেট ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং মার্কেট উঠছে। তখন জোয়ারের মতো আপনার পুঁজি ফুলেফেঁপে ওঠে আপনাকে লালে লাল করে দেবে। এ সময় আপনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্ত্রীকে ডেকে বলবেন, ‘প্রিয়তমা, এত টাকা দিয়ে আমরা কী করব!’ আপনি প্রশান্তির সঙ্গে শেয়ার ব্যবসার আসল স্বাদ উপভোগ করবেন! আপনার বৈষয়িক জীবনের স্বপ্নসাধ পুরো হবে! এর জন্য আপনাকে অন্তত ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

আইনি কাঠামোর ভেতরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজার মোটামুটি এভাবেই কাজ করে। তবে অন্য সব বাজারের মতো, শেয়ারবাজারও দুষ্টুচক্রের কালো হাতের থাবা থেকে কোনোভাবেই মুক্ত নয়। দুষ্টুবুদ্ধি, টাকা এবং ধান্দাবাজির জোরে তারা বাজারকে সময় সময় বেআইনিভাবে প্রভাবিত করে লুট করে নেয় হাজার হাজার কোটি টাকা। পশ্চিমা দেশে হলে কোনো-না-কোনো সময় শিকারিদের ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর যদি পড়ে তো বাকি জীবন নির্ঘাত লালঘরে! বাংলাদেশে এ বাজিকররা সাধারণত সরকারের ছায়ায় থাকে, আর তাই তাদের কিছুই হয় না!

ড. আবু এন এম ওয়াহিদ : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি. যুক্তরাষ্ট্র



আরো পড়ুন–




No comments:

Post a Comment